প্রকাশিত: ০৮/০৫/২০১৮ ৭:৪৭ এএম , আপডেট: ১৭/০৮/২০১৮ ৩:১১ এএম

চট্টগ্রামে আলোচিত তাসপিয়া হত্যা মামলার পাঁচ আসামি এখনো গ্রেফতার হয়নি। প্রধান আসামি আদনান মির্জাকে জিজ্ঞাসাবাদও শুরু করতে পারেনি পুলিশ। ধরা পড়েনি তাসপিয়াকে বহনকারী অটোরিকশা চালকও।

তাসপিয়া হত্যা মামলার অগ্রগতি নিয়ে পুলিশের বক্তব্য, তাসপিয়াকে বিষ খাইয়ে নাকি নির্যাতনের মাধ্যমে বা অন্য কোনভাবে হত্যা করা হয়েছে তা জানা যাবে ভিসেরা রিপোর্ট ও সিআইডি প্রতিবেদনে।

নিউজ ডেস্ক::
গত বৃহস্পতিবার দুপুরে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের ফরেনসিক বিভাগের প্রধানের নেতৃত্বে চার সদস্যের একটি টিম তাসপিয়ার ময়নাতদন্ত শেষ করে প্রয়োজনীয় আলামত পাঠিয়েছে ঢাকার মহাখালীর সিআইডির ল্যাবরেটরিতে। প্রতিবেদন হাতে পাওয়ার পর জানা যাবে কিভাবে হত্যার শিকার হলো তাসপিয়া।

তবে প্রতিবেদনে যাই আসুক না কেন এখনো অধরাই রয়েছে তাসপিয়াকে বাসা থেকে ডেকে নিয়ে হত্যার পর পতেঙ্গা সমুদ্রকূলের নেভাল বিচে লাশ ফেলানোর সঙ্গে জড়িতরা।

চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত উপ কমিশনার (প্রসিকিউশন) নির্মলেন্দু বিকাশ চক্রবর্তী বলেন, তাসপিয়া হত্যা মামলার প্রথম আসামি আদনানকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আদালতে ১০ দিনের রিমান্ড আবেদন করা হয়েছিল বৃহস্পতিবার। রোববার শুনানি শেষে রিমান্ডের অনুমতি মিলেনি। গাজীপুর কিশোর সংশোধনাগারের তত্ত্বাবধায়কের উপস্থিতিতে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে বলেছেন আদালত।

তবে তাসপিয়া হত্যার রহস্য উদঘাটনে পুলিশের ভূমিকা নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন বাংলাদেশ মানবাধিকার কমিশনের ডেপুটি গভর্নর ও চট্টগ্রাম বিভাগের প্রেসিডেন্ট আমিনুল হক বাবু।

তিনি বলেন, সমসাময়িক অনেক ক্লু-লেস ঘটনা পুলিশকে অতি অল্প সময়ের মধ্যে উদঘাটন করে বাহবা নিতে আমরা দেখেছি। কিন্তু তাসপিয়া হত্যার রহস্য উদঘাটনে পুলিশের ভূমিকা নিয়ে রহস্য সৃষ্টি হয়েছে।

আমিনুল হক বাবু বলেন, আমি দ্ব্যার্থহীনভাবে বলতে পারি- পুলিশ চাইলে দু-একদিনের মধ্যেই তাসপিয়া হত্যা মামলার সকল আসামিকে গ্রেফতার করতে পারে।

ক্ষোভ প্রকাশ করে তিনি বলেন, পুলিশ পারবে না কেন! এরাতো চট্টগ্রাম বা দেশের কোনো না কোনো স্থানে আছে। তাদের গ্রেফতারে গড়িমসি কেন?

তাসপিয়ার বাবা মোহাম্মদ আমিনের অভিযোগ, তাসপিয়া হত্যার ঘটনায় দায়েরকৃত মামলাটি ধামাচাপা দিতে একটি মহল ব্যস্ততম সময় কাটাচ্ছে। তাসপিয়া হত্যার প্রধান আসামি আদনানকে ছাড়া আর কোনো আসামি গ্রেফতার হচ্চে না।

তিনি বলেন, পুলিশ তদন্তের জন্য যখন যাই চাচ্ছে, সবই দিচ্ছি। মামলার তদন্তে যেমন অগ্রগতি নেই, তেমনি আসামি গ্রেফতারে অনীহা ভাব দেখা যাচ্ছে।

তাসপিয়াকে বাসা থেকে বের করে নেয়ার পর থেকে ঘটনা বর্ণনা দিয়ে মোহাম্মদ আমিন বলেন, তাসপিয়াকে খুঁজে না পেয়ে আদনান মির্জাকে বাসায় ডেকে আনা হয়েছিল। আদনান একপর্যায়ে ফোন করে ডেকে আনে সোহেল, শওকত মিরাজ, আসিফ মিজান, ইমতিয়াজ সুলতান ইকরাম ও ফিরোজকে।

তিনি বলেন, তারা প্রথমে আদনানকে ছেড়ে দেয়ার জন্য সময় বেঁধে দেয়। পরে আধাঘণ্টার মধ্যে তাসপিয়াকে বাসায় পাঠানোর আশ্বাস দিয়ে আদনানকে ছাড়িয়ে নিয়ে যায়।

মোহাম্মদ আমিন বলেন, সোহেল ও আদনান এক সঙ্গেই থাকতো। ঘটনার দিন সোহেলের কাছ থেকেই জানতে পারি তাসপিয়া আদনানের সঙ্গে রেস্টুরেন্টে। ওই দিন তাসপিয়ার আম্মু সোহেলের কাছ থেকে নম্বর নিয়ে আদনানকে কল করে বলে, তাসপিয়াকে বাসায় পাঠিয়ে দিতে।

তিনি বলেন, সোহেলকে গ্রেফতার করতে পারলে হত্যার প্রকৃত ঘটনা জানা যাবে। তবে তাসপিয়াকে হত্যায় আদনানই দায়ী বলে দাবি করেন হতভাগ্য এই বাবা।

কান্নাজড়িত কণ্ঠে তাসপিয়ার বাবা বলেন, আদনান তার বন্ধুদের মাধ্যমে আমার মেয়েকে খুন করেছে। আমি এই হত্যার সঙ্গে জড়িতদের মৃত্যুদণ্ড চাচ্ছি। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর আপনিই আমাদের অভিভাবক। আপনার হস্তক্ষেপ কামনা করছি, যাতে আর কোনো বাবা এভাবে সন্তান না হারায়।

‘এজন্য হলেও তাসপিয়া হত্যার সঙ্গে জড়িতদের বিচারের আওতায় আনার নির্দেশ দিন। এদেরকে গ্রেফতার করে বিচার নিশ্চিত করুন’ একথা বলেই কান্নায় ভেঙে পড়েন তিনি।

তাসপিয়া মৃতদেহ উদ্ধারে পর বৃহস্পতিবার দুপুরে মোহাম্মদ আমিন ছয়জনের নাম উল্লেখ করে একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। এই মামলার দুই নম্বর আসামি সোহেল।

মামলার এজাহারে মোহাম্মদ আমিন উল্লেখ করেন, আদনান মির্জার সঙ্গে তাসপিয়ার বন্ধুত্ব হয়েছে দুই-তিন মাস আগে। একপর্যায়ে তাদের মধ্যে বিভিন্ন বিষয়ে মনোমালিন্য সৃষ্টি হয়েছে। তাই আমার মেয়ে তাসপিয়ার প্রতি আক্রোশের বশবর্তী হয়ে বাসা থেকে ডেকে নিয়ে আদনান মির্জাসহ মামলার অপরাপর আসামিদের সহায়তায় নেভাল বিচ এলাকায় নিয়ে তাকে অজ্ঞাত আসামিদের পরস্পর যোগসাজশে পূর্বপরিকল্পিতভাবে হত্যা করেছে।

এই মামলার ষষ্ঠ নম্বর আসামী ফিরোজ। আর প্রধান আসামি আদনান মির্জা। আদনান মির্জা ফিরোজের পরিচালিত ‘রিচ কিডস’ নামের গ্যাংয়ের (এডমিন) প্রধান। আর বাকি চারজন তার সেই গ্যাংয়ের সদস্য।

মামলার আসামিদের মধ্যে ফিরোজ অস্ত্রসহ একধিকবার আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে ধরা পড়ে। অপর তিন আসামি হলো- সানশাইন গ্রামার স্কুলের নবম শ্রেণির ছাত্র শওকত মিরাজ ও আসিফ মিজান এবং আশেকানে আউলিয়া ডিগ্রি কলেজের এইচএসসির ছাত্র ইমতিয়াজ সুলতান ইকরাম।

আদনানের বাবা ইস্কান্দার মির্জা বলেন, সোহেলই তাসপিয়াকে আদনানের সঙ্গে একমাস আগে পরিচয় করিয়ে দিয়েছে। আমি চাই তাসপিয়ার মৃত্যু রহস্য উন্মোচন হোক।

কথা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এই সোহেলের মাধ্যমে আসিফ মিজানের সঙ্গে আদনানের পরিচয় হয়। এর পর আসিফ মিজানের সূত্র ধরে ফিরোজের সঙ্গে আদনানের পরিচয়।

আদনানকে গ্রেফতারের বর্ণনা দিয়ে বাবা ইস্কান্দর মির্জা বলেন, আসিফ মিজানই ২ মে বুধবার বিকালে আদনানকে কল করে বাসা থেকে ডেকে নিয়ে পুলিশের হাতে তুলে দিয়েছে। আসিফ মিজান বাসার একটু সামনে থেকে আদনানকে প্রাইভেটকারে তুলে মুরাদপুর নিয়ে যায়। সেখানে আকরাম নামে একজন এসে আদনানের সাথে দেখা করে কিছু দিকনির্দেশনা দেয়।

তিনি জানান, পরে আসিফ মিজান ও আকরাম ওই গাড়িতে করে আদনানকে নাছিরাবাদ এলাকায় নিয়ে যায়। সেখানে আসাদ নামে একজনের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়ে চলে যায় তারা। আসাদ পাঁচলাইশ থানার অন্তত ১০০ গজ উত্তরে মির্জাপুল এলাকায় নিয়ে পুলিশের একটি কালো হাইয়েস গাড়িতে আদনানকে তুলে দেয়।

চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশের কর্ণফুলী জোনের সহকারী কমিশনার জাহেদুল ইসলাম বলেন, তাসপিয়া হত্যা মামলার ঘটনায় এখনো উল্লেখযোগ্য কোনো অগ্রগতি নেই। তবে এটি হত্যা মামলা হিসেবে নিয়েই তদন্ত করা হচ্ছে।

তিনি বলেন, ইতোমধ্যে সিসিটিভির ভিডিও ফুটেজ পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে তাসপিয়াকে বহনকারী সিএনজি অটোরিকশাটি সনাক্ত করা হয়েছে। সেটি আটকের জন্য কাজ করছে পুলিশের কয়েকটি টিম।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে পুলিশের এক কর্মকর্তা বলেন, স্কুল পড়ুয়া কোনো ছাত্রের পক্ষে এককভাবে পরিকল্পনা করে এমন হত্যাকাণ্ড ঘটানো সম্ভব নয়। পেছনে কোনো মাস্টারমাইন্ড থাকাটাই যুক্তিসঙ্গত।

সিএমপি পতেঙ্গা থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) আবুল কাসেম ভূইঁয়া বলেন, এক নম্বর আসামি আদনান মির্জা গ্রেফতার হয়েছে ঘটনার পর পরই। বাকি আসামিদের গ্রেফতারে পুলিশি তৎপরতা অব্যাহত আছে।

গত ২ মে সকালে নগরীর পতেঙ্গা সমুদ্রকূলে নেভাল একাডেমির অদূরে ১৮ নম্বর ঘাট এলাকায় চোখ ও নাক-মুখ থেঁতলানো অবস্থায় তাসপিয়ার মরদেহ পায় পুলিশ। প্রথমে অজ্ঞাত তালিকায় থাকা তাসপিয়ার নিথর দেহ শনাক্ত হয় দুপুরের পরে।

তাসপিয়া কক্সবাজারের টেকনাফ পৌরসভার ৫ নং ওয়ার্ডের ডেইলপাড়া এলাকার মো. আমিনের মেয়ে। চট্টগ্রাম নগরীর ও আর নিজাম রোডে তাদের বাসা। তাসপিয়া সানশাইন গ্রামার স্কুলের নবম শ্রেণির ছাত্রী।সুত্র” পরিবর্তন

পাঠকের মতামত